Latest Notes

Assertive Sentence Narration Change Worksheet (Direct Speech to Indirect Speech) The Greenhouse Effect – Carl Dennis | Class 12 Sonnet no. 73 That time of year thou mayst in me behold | Class 12 Hawk Roosting – Ted Hughes | Class 12 Down The Rabbit-Hole – Lewis Carrol | Class 12 Tara- Mahesh Dattani | Class 12 Our Casuarina Tree – Toru Dutt | Class 12 From A Room of One’s Own [SHAKESPEARE’S SISTER] – Virginia Woolf | Class 12 The Night Train at Deoli – Ruskin Bond (বঙ্গানুবাদ) | Class 12 Amarnath-Sister Nivedita MCQs and Answers | Class 11

বাড়ির ঠিক মাঝখানে উঁচু চাঁচের বেড়া। খুব লম্বা মানুষের মাথা ছাড়িয়েও হাতখানেক উঁচু হবে। বেড়া ডিঙিয়ে কারও নজর চলবে না, অবশ্য যদি উঁচু কিছুর উপর দাঁড়িয়ে নজর চালানো না হয়। নজর দেবার অন্য উপায় আছে : ফুটোতে চোখ পাতা।

বাড়িটাকে সমান দু-ভাগ করেছে বেড়াটা, পশ্চিমের ভিটার লম্বা দাওয়া ভাগ করে, উঠান ভাগ করে সদরের বেড়ার চার হাত ফাঁকের ঠিক মাঝখান দিয়ে খানিক এগিয়ে বাড়িতে ঢুকবার এই ফাঁক আড়াল করতে দাঁড় করানো সামনের পর্দা-বেড়াটার ঠিক মাঝখানে গিয়ে ঠেকেছে।

আগে, প্রায় সাত বছর আগে, গোবর্ধন ও জনার্দনের বাপ অনন্ত হাতি যখন বেঁচে ছিল, তখন বাড়িতে ঢুকবার পথ ছিল একটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এই পথের সামনেও বসানো ছিল একটা আড়াল-করা পর্দা বেড়া। ভাগের সময় পথটা পড়েছিল জনার্দনের ভাগে। সদরের বেড়ার আরেক প্রান্তে, অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব কোণে বেড়া কেটে নতুন একটা প্রবেশ-পথ করে নিতে অত্যন্ত অসুবিধা থাকায় গোল বেধেছিল। ঢুকবার-বেরোবার পথই যদি না থাকল, বাড়ির এমন ভাগ দিয়ে সে কী করবে – গোবর্ধন প্রতিবাদ জানিয়েছিল। মালিকদের মানতে হয়েছিল যে তার আপত্তি সংগত। অনেক মাথা ঘামিয়ে তারপর সালিশরা, যাদের প্রধান ছিলেন সদরের সেরেস্তাদারের বাবা প্রাণধন চক্রবর্তী জ্যোতির্বিদ্যাভূষণ, ব্যবস্থা দিয়েছিলেন ভাগের বেড়ার দু-পাশে সদর বেড়া দু-হাত করে কেটে দুই অংশের ঢুকবার বেরোবার পথ করা হোক, আর পুরোনো পর্দা-বেড়া তুলে এনে স্থাপন করা হোক এই বিভক্ত পথের সামনে; কারণ ও-বেড়াটাও দু-ভায়ের বাপের সম্পত্তি। অতএব দুজনের ওতে সমান অধিকার।

জনার্দন আপত্তি করে বলেছিল আড়াল-করা বেড়া সরালে সদর বেড়ার কোণের পুরোনো পথের ফাঁকে রাস্তার লোক যে তার বাড়ির বউ-ঝিদের দেখতে পাবে, তার কী হবে? সে এমন কী অপরাধ করেছে যে, গাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে বন্ধ করতে হবে বেড়ার ফাঁক ! রীতিমতো সমস্যার কথা। সালিশরা যখন মীমাংসা খুঁজতে মাথা ঘামাচ্ছেন, গোবর্ধন উদার ও উদাসভাবে বলেছিল, তিন হাত বেড়ার ফাঁক বন্ধ করার পয়সা খরচ করতে যদি জনার্দনের আপত্তি থাকে, সে এদিকের অংশ নিক। সদর বেড়ার ফাঁকের অসুবিধা ভোগ করতে গোবর্ধন রাজি আছে।

অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সালিশরা হঠাৎ সমস্যাটার চমৎকার মীমাংসা আবিষ্কার করেন। কেন, দু-পাশে দু-হাত করে পথ করতে সদর বেড়ার মাঝখানে চার হাত অংশ তো কাটতেই হবে, তাই দিয়ে অনায়াসে বন্ধ করা যাবে জনাদনের অংশের সদর বেড়ার পুরোনো ফাঁক!

এমনি দুর্যোধনী জেদি হিংসার চুলচেরা ভাগাভাগির প্রতীক হয়ে ভাগের বেড়াটি দাঁড়িয়ে আছে সাত বছর। অনন্ত হাতির শ্রাদ্ধের দশ দিন পরে বেড়াটা উঠেছিল। আদালত কুরুক্ষেত্রে তারপর যত লড়াই হয়ে গেছে দু-ভায়ের মধ্যে জমিজমা নিয়ে, যত হাতাহাতি গালাগালি হয়ে গেছে বাগানের ফল, পুকুরের ঘাট, গাছের মরা ডালের ভাগ নিয়ে তারও যেন প্রতীক হয়ে আছে এই বেড়াটিই। জীর্ণ হয়ে এসেছে বেড়াটা, এখানে ওখানে মেরামত হয়েছে, আর এখানে পড়েছে মাটির চাবড়া, ওখানে গোঁজা হয়েছে ন্যাকড়া, সেখানে সাঁটা হয়েছে কাগজ।

বেড়ার ফুটোয় চোখ রেখে উঁকি মারা চলত – দু-পাশ থেকেই। হঠাৎ গোবরগোলা জল বেড়া ডিঙিয়ে এসে পড়ত গায়ে। গোবর্ধনের মেয়ে পরিবালা একদিন চোখ পেতে আছে বেড়ার ফুটোয়, জনাদনের মেয়ে তাকে তাকে থেকে একটা কঞি সেই
ফুটো দিয়ে চালান করে দিল তার চোখের মধ্যে। চোখ যায় যায় হল পরিবালার, মাথা ফাটে ফাটে হল গোবর্ধন ও জনার্দন দু-ভায়ের, ক-দিন পাড়ায় কান পাতা গেল না দু-বাড়ির মেয়েদের গলাবাজিতে। বেড়ায় কাঁথা-কাপড় শুকতে দিলে অদৃশ্য হয়ে যেত। এঁটো-কাঁটা, নোংরা, ছেলেমেয়ের মল বেড়া ডিঙিয়ে পড়ত একপাশ থেকে অন্যপাশে। এ পাশের পুই বেড়া বেয়ে উঠে ও পাশের আয়ত্তে একটি ডগা একটু বাড়ালেই টেনে যতটা পারা যায় ছিঁড়ে নেওয়া হত। বেড়া ডিঙিয়ে অহরহ আসা-যাওয়া করত সমালোচনা, মন্তব্য, গালাগালি, অভিশাপ। চেরা বাঁশের বেড়াটাকে মাঝে রেখে এমন একটানা শত্রুতা চলত দু-পাশের দুটি পরিবারের মধ্যে যে, সময় সময় মনে হত কবে বুঝি ওপাশের চালা পুড়িয়ে দেবার ঝোঁক সামলাতে না পেরে এপাশে নিজের চালাতেই আগুন ধরিয়ে দেয়!

গোলমাল এখনও চলে, বিদ্বেষ এখনও বজায় আছে পুরো মাত্রায়। তবে গোড়ার দিকের মতো খুঁটিনাটি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অহরহ হাঙ্গামা চলে না, গায়ে পড়ে সহজে কেউ ঝগড়া বাধায় না। ঢিলটি মারলে যে পাটকেলটি খেতে হবে দু-পাশের মানুষগুলি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে সংযম অভ্যাস করতে বাধ্য হয়েছে। আক্রমণাত্মক হিংসা কমে এসে এখন দাঁড়িয়েছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অবহেলাত্মক মনোভাবে। খোঁচাবার ও গায়ের ঝাল ঝাড়বার প্রক্রিয়াও ক্রমে ক্রমে বেশ কৌশলময় ও মার্জিত হয়ে উঠেছে। এপাশের ছেলেমানুষ কানাই মাঝের বেড়ার মাহাত্ম্য ভুলে ও-পাশে সমবয়সি বলাইয়ের সঙ্গে খেলতে গেলে, শত্রুপক্ষের ছেলেকে আয়ত্তে পেয়েও ও-পাশের কেউ তাকে ধরে পিটিয়ে দেয় না, আচ্ছা করে মার দেওয়া হয় বলাইকে। এ-পাশ থেকে হাঁক ওঠে, কানাই! কানাই এলে তাকে চড়চাপড় মেরে উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন করা হয়, ও-বাড়ি মরতে গেছিলি কেনরে, বেহায়া পাজি বজ্জাত? ও-পাশ থেকে জবাব আসে বলাই-এর প্রতি আরও জোর গলায় শাসানোতে, ফের যদি ও বাড়ির কারো সাথে তুই খেলিস হারামজাদা নচ্ছার ….

দু-পাশেই ছেলেমেয়ে আছে, হাজার বলে তাদের বোঝানও যায় না যে, বেড়ার ও-পাশ যেতে নেই। ছেলেমেয়েরা তাই নিরাপদ থাকে। তবে কুকুর বেড়ালের রেহাই নেই। এপাশের বেড়াল ও-পাশে হাঁড়ি খেতে গেলে তার রক্ষা থাকে না।

দু-পাশের হাঁড়িই যখন প্রায় শূন্য থাকছে দুর্ভিক্ষের দিনে, জনার্দনের ছেলে চন্দ্রকুমারের বউ রানিবালার পোষা বিড়ালটা মেউ মেউ করে বেড়াচ্ছে খিদেয় কাতর হয়ে, গোবর্ধন একদিন কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে এল আধসেরি একটা রুইমাছ। মাছ দেখে খুশি হয়ে হাসি ফুটল সবার মুখে, দু-মুঠো চাল সেদিন বেশি নেওয়া হল এই উপলক্ষ্যে। গোবর্ধনের ছেলে সূর্যকান্তের বউ লক্ষ্মীরানি আঁশবটি পেতে কুটতে বসল মাছ।

মাছ কাটা শেষ হয়েছে, কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যকান্ত বউয়ের দিকে গোড়ায় যেমন তাকাত প্রায় সেই রকম সপ্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাছের দিকে, কোথা থেকে রানিবালার আদুরে বিড়াল এসে এক টুকরো মাছ মুখে তুলে নিল। মাছকাটা বঁটিটা তুলেই সূর্যকান্ত বসিয়ে দিল এক কোপ। রানিবালার আদুরে বিড়াল একটা আওয়াজ পর্যন্ত না করে মরে গেল। মাছের টুকরোটা মুখ থেকে খসে পড়ায় লক্ষ্মীরানি সেটা তুলে রাখল চুপড়িতে।

পথের ধার থেকে মরা বিড়ালটা কুড়িয়ে নিয়ে গেল চণ্ডী বসাক। চাল ছিল না। কিন্তু ঘরে তার একটু নুন আর একটু হলুদ-লংকা ছিল। ঘুরে ঘুরে হত্যা দিয়ে দুটি খুদকুঁড়ো চণ্ডী জোগাড় করে নিয়ে এল। ঝাল ঝাল বিড়ালের মাংস দিয়ে সে-দিন সে দু-বেলা ভোজ খেল সপরিবারে।

হত্যাকাণ্ডের খবরটা রানিবালা পেল পাঁচুর মার কাছে। ও-বাড়িতে পাঁচুর মা দুটি চালের জন্য গিয়েছিল, অনেকক্ষণ ধন্না দিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত পায়নি। নিজের চোখে সে ঘটনাটা দেখেছে আগাগোড়া। এ কী কাণ্ড মা, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করিস, হিংসে করে মা-ষষ্ঠীর বাহনকে মারলি একাদশীর দিন, এত শত্ৰুতা?

‘দুটি চাল দিবি বউ? দে মা, দুটি চাল? বিড়াল ছানা দেব তোকে একটা, তোর পায়ে ধরি খুদকুঁড়ো যা হোক দুটি দে।”

‘কোথা পাব গো? চাল বাড়ন্ত। খুদকুঁড়ো শাউড়ি আগলে আছে।’

বলে বিড়ালের শোকে রানিবালা কাঁদতে থাকে, বাড়ির সকলের কাছে নালিশ জানায়। সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, অভিশাপও দিয়ে বসে ও-পাশের খুনেদের। ছেলেবেলা থেকে রানিবালা বিড়াল পুষতে ভালোবাসে, কত পোষা বিড়াল তার মরে আর হারিয়ে গেছে। ও-বাড়ির লোক হত্যা না করলে হয়তো বিড়ালটার জন্য এত শোক তার হত না।

কিন্তু এমনি অবাক কাণ্ড, এই নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাধানোর বদলে জনার্দন তাকেই ধমক দিয়ে বলল, ‘আঃ চুপ কর বাছা। বাড়াবাড়ি কোরো না।’

চন্দ্রকান্তও প্রায় ধমকের সুরে বলল, ‘তোমার বিড়াল যায় কেন চুরি করে খেতে?

রানিবালা হকচকিয়ে যায়, ভেবে পায় না ব্যাপারখানা কী। রাগে অভিমানে তার গা জ্বালা করে, ভাবে না খেয়ে শুয়ে থাকবে কিন্তু ভরসা পায় না। কারও পেট কলমিশাক-সেদ্ধ দিয়ে দুটি ভাত খেয়ে ভরে না। কেউ যদি তাকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি না করে সে না খেয়ে গোসা করে শুয়ে থাকলেও!

চন্দ্রকান্ত তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় পুলপারের জমিটা না বেচে আর উপায় নেই। গোবর্ধন ও জনার্দন দুজনে মিলে না বেচলে জমিটা বেচবারও উপায় নেই। কাল দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করছে প্রাণধন চক্রবর্তীকে জমিটা বেচে দেবে। এখন কোনো কারণে গোবর্ধন বিগড়ে গিয়ে বেঁকে বসলে মুশকিল হবে।

‘ঝগড়াঝাটি কোরো না খবরদার, ক-দিন মুখ বুজে থাকো।’

বিড়াল মারার সময় গোবর্ধন উপস্থিত ছিল না। ফিরে এসে ব্যাপার শুনে সে-ও অসন্তুষ্ট হয়ে সূর্যকে বলে, ‘একটু কাণ্ডজ্ঞান নেই তোদের? এমনি করে ফ্যাকড়া বাধাও, ব্যাস, জমি বেচাও খতম। খেয়ো তখন কচুপোড়া সিদ্ধ করে। খবরদার, কেউ ঝগড়া করবে না ওদের সাথে। মুখ বুঝে থাকো ক-দিন।’

সাত বছরের শত্রুতা স্বার্থের খাতিরে একদিনে হঠাৎ স্থগিত হয়ে গেল। দু-পারেই কটু কথা যদি বা কিছু বলা হল, হল চুপি চুপি, চাপা গলায়, নিজেদের মধ্যে। এপার কথা বলল না বটে ওপারের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু ওপারকে শোনাবার জন্য এবার চেঁচাল, ও কানাই, ওদের বেগুন খেতে গোরু ঢুকেছেরে। ওপারও চেঁচাল এপারকে শুনিয়ে ‘ও বলাই, ওদের পুঁটু পুকুরপাড়ে একলা গেছেরে।’ আমতলায় কানাই বলাইকে খেলতে দেখে কোনো পার কিছু বলল না। এপারের ছেলে ওপারে যাওয়ায় ওপারের ছেলে চড় খেল না। লক্ষ্মীরানির বিড়াল প্রায় সারাটা দুপুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল ওপারের দাওয়ার কোণে জড়ো করা ছেঁড়া চটে। হাতটা মনটা বারবার নিসপিস করে উঠলেও রানিবালা পর্যন্ত তাকে কিছু বললে না। ওপারের পুঁই গাছের সতেজ ডগাটি লক লক করে বাতাসে দুলতে লাগল এপারের এলাকায়!

কথা যা বলাবলি হল তিন দিনে দু-পারের মধ্যে, তা শুধু গোবর্ধন আর জনার্দনের জমি বিক্রি নিয়ে গম্ভীর নৈর্ব্যক্তিক কথা, তবু এভাবেও তো সাত বছর তারা কথা বলেনি।

দলিল রেজিস্ট্রি করিয়ে টাকা পাবার দিন সকালে বেড়ার এপার থেকেই গোবর্ধন বলে, ‘কখন রওনা হবে, জনা?’

‘এই খানিক বাদেই,’ জবাব দিয়ে, একটু থেমে জনার্দন যোগ দেয়, ‘ফেলনার জ্বরটা বেড়েছে।’

ফেলনা রানিবালার ছেলে।

একসাথে বেরোয় দুজনে, জনার্দন ডাক দিয়ে নিয়ে যায় গোবর্ধনকে। একসাথে বাড়ি থেকে বেরোবার কোনো দরকার অবশ্য ছিল না। চক্রবর্তীর বাড়ি হয়ে তারা সাব রেজেস্ট্রারের অফিসে রওনা হবে, একে একে গিয়ে সেখানে জুটলেও চলত।
কিন্তু সাত বছর বিবাদ করে আর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কাটাবার পর দু-ভাই যখন শান্তভাবে ক-দিন ধরে কথা বলে, তখন কী আর দরকার আছে অত হিসেব করে সব কাজ করার! দুজনে চলতে থকে একরকম নির্বাক হয়েই। মাঝে মাঝে এ ওর মুখের দিকে তাকায় আড়চোখে। সাত বছরের দুজনের বয়স যেন বিশ বছর বেড়ে গেছে সংসারের চাপে, দুর্ভিক্ষের গত দু-বছরেই যেন বেশি বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও কী আছে ভগবান জানেন!

‘দরটা সুবিধা হল না।’

‘উপায় কী?’

‘ডবল দরে এমন জমি মিলবে না।’

‘ঠিক। লতিফের সেচা জমির চেয়ে ভালো ফসল দিয়েছে গতবারে।’ গোবর্ধন এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে পড়ে। শোনো বলি, জনা। না বেচলে হয় না জমিটা? এক কাজ করি আয়। না বেচে বাঁধা রাখি, পারি তো ছাড়িয়ে নেব দুজনে মিলে।

‘চক্কোত্তি মশায় কি রাজি হবে?’

‘রাজি না হয় তো মধু সা-র কাছে বাঁধা দেব। নয়তো রথতলায় নিকুঞ্জকে। বেচে দিলে তো গেল জন্মের মতো। যদি রাখা যায়!’

গাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোবর্ধন ও জনার্দন — অনন্ত হাতির দুই ছেলে, কথাটা বিচার ও বিবেচনা করে দেখতে থাকে। দেখে লোকের মনে হয় যেন আলাপ করছে দুটি সাঙাত।

এদিকে জ্বর বাড়তে বাড়তে ফেলনার যায় যায় অবস্থা হয় দুপুর-বেলা। চাঁচের বেড়া থাকলেও ওপারে সব টের পায় সবাই। সূর্যের মা ইতস্তত করে অনেকক্ষণ ফিস ফিস করে সূর্য আর লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করে কয়েকবার, ‘যাব নাকি?’ তারপর বেলা পড়ে এলে সতীরানির বিনুনি কান্না শুনে হঠাৎ মনস্থির করে সাত বছর পরে সূর্যের মা বেড়ার ওপারে যায়, আস্তে আস্তে গিয়ে বসে ফেলনার শিয়রে চাঁদের মার পাশে। সন্ধ্যার আগে ফেলনা মারা গেলে মড়া-কান্না শুনে এপারের বাকি সকলেও হাজির হয় ওপারে। সাত বছরে পাঁচবার মড়া-কান্না উঠেছে জনার্দনের অংশে, কিন্তু গোবর্ধনের অংশ থেকে বেড়া পেরিয়ে কেউ কখনও আসেনি। সাত বছর পরে আজ বেড়ার দু-দিকের মেয়েরা বেড়ার একদিকে হয়ে একসঙ্গে কাঁদতে আরম্ভ করে। চাঁদ শোকের নেশায় পাগলের মতো কাণ্ড আরম্ভ করলে সূর্য তাকে ধরে রাখে। একটু রাত করে গোবর্ধন ও জনার্দন যখন বাড়ি ফেরে তখনও দেখা যায় ওপারের প্রায় সকলেই রয়েছে এপারে, ওপারের ছেলেমেয়েগুলি ঘুমিয়ে পড়েছে এপারের মাদুরে কাঁথায়, এপারের ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে।

তাই বলে যে খিটিমিটি ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে গেল দু-পারের মধ্যে চিরদিনের জন্য, উঠানের মাঝখানে পুরোনো চাঁচের বেড়াটা থেকেও রইল না, তা নয়। মানুষ তাহলে দেবতা হয়ে যেত। তবে পরের আশ্বিনের ঝড়ে পচা বেড়া পড়ে গেলে সেটা আবার দাঁড় করবার তাগিদ কোনো পারেরই দেখা গেল না। বেড়াটা ভেঙে
জ্বালান হতে লাগল দু-পারেরই উনানে। দু-পারের ঝাটার সঙ্গেও সাফ হয়ে যেতে লাগল বেড়ার টুকরো আবর্জনা। শেষে একদিন দেখা গেল দাওয়ার বেড়াটি ছাড়া উঠানে বেড়ার চিহ্নও নেই, বাড়ির মেয়েদের ঝাঁটায় দুটির বদলে একটি উঠান তকতক করছে।

আরও পড়ুন –
অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনি (কবিতা)- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
পরিচয় (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাট (কবিতা) – যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
এখানে আকাশ নীল (কবিতা) – জীবনানন্দ দাশ
সামান্যই প্রার্থনা (কবিতা) – বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী
দস্যু -কবলে (গল্প) – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
নতুনদা (গল্প) – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সিংহের দেশ (গল্প) – বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবতামুড়া ও ডম্বুর (গল্প) – সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা
সুভা (ছোটোগল্প) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বেড়া (ছোটোগল্প) – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

Spread the love

You cannot copy content of this page