Latest Notes

MCQ from The Bangle Sellers – Sarojini Naidu MCQ from Composed Upon Westminster Bridge- Wordsworth | Class 11 Assertive Sentence Narration Change Worksheet (Direct Speech to Indirect Speech) The Greenhouse Effect – Carl Dennis | Class 12 Sonnet no. 73 That time of year thou mayst in me behold | Class 12 Hawk Roosting – Ted Hughes | Class 12 Down The Rabbit-Hole – Lewis Carrol | Class 12 Tara- Mahesh Dattani | Class 12 Our Casuarina Tree – Toru Dutt | Class 12 From A Room of One’s Own [SHAKESPEARE’S SISTER] – Virginia Woolf | Class 12

চারটা পঁয়তাল্লিশের প্যাসেঞ্জারে ট্রেনটিকে রওনা করিয়া দিয়া নদেরচাঁদ নতুন সহকারীকে ডাকিয়া বলিল, আমি চললাম হে!
নতুন সহকারী একবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
নদেরচাঁদ বলিল, আর বৃষ্টি হবে না, কি বলো?
নতুন সরকারি একবার জলে জলময় পৃথিবীর দিকে চাহিয়া বলিল, আজ্ঞে না।

নদেরচাঁদ লাইন ধরিয়া এক মাইল দূরে নদীর উপরকার ব্রিজের দিকে হাঁটিতে লাগিল। পাঁচ দিন অবিরত বৃষ্টি হইয়া আজ এই বিকালের দিকে বর্ষণ থামিয়াছে। পাঁচ দিন নদীকে দেখা হয় নাই। নদেরচাঁদ ছেলে মানুষের মতো ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল। আকাশে যেমন মেঘ করিয়া আছে, হয়তো আবার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রবল ধারায় বর্ষণ শুরু হইয়া যাইবে। তা হোক। ব্রিজের একপাশে আজ চুপচাপ বসিয়া কিছুক্ষণ নদীকে না দেখিলে সে বাঁচিবে না। পাঁচদিনের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি না জানি নদীকে আজ কী অপরূপ রূপ দিয়াছে? দুদিকে মাঠ ঘাট জলে ডুবিয়া গিয়াছিল, রেলের উঁচু বাঁধ ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে দু’পাশ চাহিয়া চাহিয়া নদীরচাঁদ নদীর বর্ষন – পুষ্ট মূর্তি কল্পনা করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

ত্রিশ বছর বয়সে নদীর জন্য নদেরচাঁদের এত বেশি মায়া একটু অস্বাভাবিক। কেবল বয়সের জন্য নয়, ছোট হোক, তুচ্ছ হোক, সে তো একটা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, দিবারাত্রি মেল, প্যাসেঞ্জার আর মালগাড়িগুলো তীব্র বেগে ছুটাছুটি নিয়ন্ত্রিত করিবার দায়িত্ব যাহাদের সেও তো তাহাদেরই একজন, নদীর জন্য এমনভাবে পাগলা হওয়া কি তার সাজে? নদেরচাঁদ সব বোঝে, নিজেকে কেবল বুঝাতেই পারে না। নিজের সেই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।

অস্বাভাবিক হোক, নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে। নদীর ধারে তার জন্ম হইয়াছে, নদীর ধারে সে মানুষ হইয়াছে, চিরদিন নদীকে সে ভালোবাসিয়াছে। দেশের নদীটি তার হয়তো এই নদীর মতো এত বড়ো ছিল না, কিন্তু শৈশবে, কৈশোরে, আর প্রথম যৌবনের বড়োছোটোর হিসেব কে করে? দেশের সেই ক্ষীনস্রোতা নির্জীব নদীটি অসুস্থ দুর্বল আত্মীয়ার মতোই তার মমতা পাইয়াছিল। বড়ো হইয়া একবার অনাবৃষ্টির বছরে নদীর ক্ষীন স্রোতধারাও প্রায় শুকাইয়া যাইবার উপক্রম করিয়াছে দেখিয়া সে  প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল; দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগিতে ভুগিতে পরমাত্মীয়া মরিয়া যাওয়ার উপক্রম করিলে মানুষ যেমন কাঁদে।

ব্রিজের কাছাকাছি আসিয়া প্রথমবার নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল। পাঁচ দিন আগেও বর্ষার জলে পরিপুষ্ট নদীর পঙ্কিল জল স্রোতের যা চাঞ্চল্য দেখিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই চাঞ্চল্য যেন ছিল পরিপূর্ণতার আনন্দের প্রকাশ। আজ যেন সেই নদীর খেপিয়া গিয়াছে, গাঢ়তর পঙ্কিল জল ফুলিয়া ফাঁপিয়া ফেনোচ্ছাসিত হইয়া আজ ছুটিয়া চলিয়াছে। এতক্ষণ নদেরচাঁদ একটি সংকীর্ণ ক্ষীনস্রোতা নদীর কথা ভাবিতেছিল। তার চার বছরের চেনা এই নদীর মূর্তিকে তাই যেন আরও বেশি ভয়ংকর, আরও বেশি অপরিচিত মনে হইল।

ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি আর সিমেন্টের গাঁথা ধারক স্তম্ভের শেষ প্রান্তে বসিয়া সে প্রতিদিন নদীকে দেখে। আজও সে সেইখানে গিয়া বসিল। নদীর স্রোত ব্রীজের সেই একদিকে ধারক স্তম্ভ গুলিতে বাধা পাইয়া ফেনিল আবর্ত রচনা করিতেছে। এত উঁচুতে জল উঠিয়া আসিয়াছে যে, মনে হয় ইচ্ছা করিলে বুঝি হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করা যায়। নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগল। পকেট খুজিয়া পুরাতন একটি চিঠি বাহির করিয়া সে স্রোতের মধ্যে ছুড়িয়া দিল। চোখের পলকে কোথায় যে অদৃশ্য হইয়া গেল চিঠিখানা! উন্মওতার  জন্যই জলপ্রবাহকে আজ তাহার জীবন্ত মনে হইতেছিল, তার সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়া চিঠিখানা যেন তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিয়াছে।

ধরিয়া বাহিরে অবিশ্রান্ত বর্ষণের সঙ্গে সুর মিলাইয়া নদেরচাঁদ বউকে প্রাণপনে একখানা পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী বিহর – বেদনাপূর্ণ চিঠি লিখিয়াছে, চিঠি পকেটেই ছিল। একটু মমতা বোধ করিল বটে, কিন্তু নদীর সঙ্গে খেলা করার লোভটা সে সামলাতে পারিল না, এক একখানি পাতা ছিড়িয়া দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া জলে ফেলিয়া দিতে লাগিল।

তারপর নামিল বৃষ্টি সে কি মুষলধারায় বর্ষণ। ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম করিয়া মেঘের যেন নতুন শক্তি সঞ্চিত হইয়াছে। নদেরচাঁদ বসিয়া বসিয়া ভিজিতে লাগিল, উঠিল না। নদী হইতে একটা অশ্রুতপূর্ব শব্দ উঠিতেছিল, তার সঙ্গে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিশিয়া হঠাৎ এমন একটা সংগত সৃষ্টি করিয়াছে যে নদেরচাঁদের মন হইতে ছেলেমানুষি আমোদ মিলাইয়া গেল, তার মনে হইতে লাগিল এই ভীষণ মধুর শব্দ শুনিতে শুনিতে সর্বাঙ্গ অবশ, অবসন্ন আসিতেছে।

ক্রমে ক্রমে দিনের স্তিমিত আলো মিলাইয়া চারিদিকে অন্ধকারে ছাইয়া গেল, বৃষ্টি একবার কিছুক্ষণের জন্য একটু কমিয়ে আবার প্রবল বেগে বর্ষণ আরম্ভ হইল, ব্রীজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন চলিয়া যাওয়ার শব্দে আকস্মিক আঘাতের ঘুম ভাঙ্গিয়া যাওয়ার মতো একটা বেদনাদায়ক চেতনা কিছুক্ষণের জন্য নদেরচাঁদকে দিশেহারা করিয়া রাখিল, তারপর সে অতি কষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইল।

বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদের চাঁদের। হঠাৎ তাহার মনে হইয়াছে রোষে ক্ষোভে উন্মত্ত এই নদীর আর্তনাদি জলরাশি কয়েক হাত উঁচুতে এমন নিশ্চিন্ত মনে এতক্ষণ বসিয়া থাকা  তাহার উচিত হয় নাই। হোক ইট, সুরকি, সিমেন্ট, পাথর, লোহালক্কড়ে গড়া ব্রিজ, যে নদী এমন ভাবে খেপিয়া যাইতে পারে তাহাকে বিশ্বাস নাই।

অন্ধকারে অতি সাবধানে লাইন ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে নদেরচাঁদ স্টেশনের দিকে ফিরিয়া চলিল। নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে। ব্রিজটা ভাঙিয়া ভাসিয়া লইয়া, দুপাশে মানুষের হাতে গড়া বাঁধ চুরমার করিয়া, সেভস্বাভাবিক গতিতে বহিয়া যাইবার পথ করিয়া লইতে চায়। কিন্তু পারিবে কি?

পারিলেও মানুষ কি তাকে রেহাই দিবে? আজ যে ব্রিজ আর বাঁধ সে ভাঙিয়া ফেলিবে, কাল মানুষ আবার সেই ব্রিজ আর বাঁধ গড়িয়া তুলবে। তারপর এই গভীর প্রশস্ত, জলপূর্ণ নদীর, তার দেশের সেই ক্ষীণস্রোতা নদীতে পরিণত হইতে না জানি মোটে আর কতদিন লাগিবে।

স্টেশনের কাছে নতুন রং করা ব্রিজটির জন্য এতকাল নদেরচাঁদ গর্ব অনুভব করিয়াছে। আজ তার মনে হইল কি প্রয়োজন ছিল ব্রিজের?

বোধ হয়, এই প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যই পিছন হইতে ৭ নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি নদেরচাঁদকে পিষিয়া দিয়া চলিয়া গেল ছোট স্টেশনটির দিকে, নদেরচাঁদ চার বছর যেখানে স্টেশনমাস্টারি করিয়াছে এবং বন্দি নদীকে ভালোবাসিয়াছে।

Spread the love

You cannot copy content of this page